করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা হবে না। জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার গড় ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফল নির্ধারণ করা হবে। এর ফলে সাড়ে ১৩ লাখের বেশি পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করে যাবেন।
এ সিদ্ধান্তের পর এখন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা, মূল্যায়নটি কোন প্রক্রিয়ায় হবে? এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। যেমন কোনো পরীক্ষার্থী জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়ে থাকলে তিনি এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পাবেন। শিক্ষা বোর্ডগুলো এ মূল্যায়নের কাজটি সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তা প্রকাশ করবে।
এবার মোট পরীক্ষার্থী ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন। এর মধ্যে ১০ লাখ ৭৯ হাজার ১৭১ জন নিয়মিত পরীক্ষার্থী। ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫০১ জন অনিয়মিত পরীক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে একটি বিষয় থেকে শুরু করে সব বিষয় পর্যন্ত ফেল করা পরীক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক মান উন্নয়ন এবং প্রাইভেট পরীক্ষার্থী রয়েছেন
করোনা সংক্রমণের বর্তমান ঝুঁকি বিবেচনায় সরকারের এ সিদ্ধান্তে পরীক্ষার্থীদের অনেকেই খুশি। আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘অটো’ পাসের কারণে ভবিষ্যতে আবার কোনো সমস্যা হয় কি না, তা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত।
এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা (নিয়মিত) ২০১৫ সালের জেএসসি ও সমমান এবং ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল গত ১ এপ্রিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষার ১০ দিন আগে ২২ মার্চ এ পরীক্ষা স্থগিত করে সরকার। সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও পরীক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায় পড়েন। শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনা পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বে শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। গত ১৭ মার্চ থেকে দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। এ সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের কাজটি করা হবে।
সবাই পাস করবেন
এবার মোট পরীক্ষার্থী ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন। এর মধ্যে ১০ লাখ ৭৯ হাজার ১৭১ জন নিয়মিত পরীক্ষার্থী। ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫০১ জন অনিয়মিত পরীক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে একটি বিষয় থেকে শুরু করে সব বিষয় পর্যন্ত ফেল করা পরীক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক মান উন্নয়ন এবং প্রাইভেট পরীক্ষার্থী রয়েছেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন , এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সবাই জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে এসেছেন। তাই সব পরীক্ষার্থীকে পাস করানো হবে। এমনকি গতবার যাঁরা ফেল করেছিলেন, তাঁদেরও জেএসসি-এসএসসির ফলের ভিত্তিতে পাস করানো হবে। তিনি জানান, বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষার ইতিহাসে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের ঘটনা আগে ঘটেনি।
বিভাগ পরিবর্তন ও উচ্চশিক্ষায় ভর্তি কীভাবে
এসএসসি পাসের পর অনেক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ পরিবর্তন করেন। কেউ বিজ্ঞান থেকে মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষায় যান। আবার ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের কেউ কেউ মানবিকে যান। এমন অবস্থায় তাঁদের মূল্যায়নটি কীভাবে হবে? আবার এইচএসসি পাসের পর শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হন। এ দুটি বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটিতে থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন করে শিক্ষক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি এবং শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা। তাঁরা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে সুপারিশ দেবেন। তার ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কীভাবে ভর্তির কাজটি হবে, সেটি এখনই বলা সমীচীন হবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি সমন্বিত পদ্ধতিতেই সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারব। সেই পরীক্ষাগুলো কীভাবে হবে, গুচ্ছ পদ্ধতি কেমন হবে, তখনকার কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ, এখনো তিন মাস বাকি আছে।’
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। কিন্তু করোনার কারণে দীর্ঘ ছয়-সাত মাসেও পরীক্ষা হয়নি। এখন পরীক্ষা হলেও আগের মতো পরীক্ষা দেওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির কী হবে, সেটি নিয়ে কিছুটা চিন্তায় আছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস।
আরও কি অপেক্ষা করা যেত
এখন বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির কাজটি ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়। এরপর জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হয়। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও ভর্তি পরীক্ষা নেয়। এ অবস্থায় শিক্ষা বোর্ডগুলোর ভাবনা ছিল, যেহেতু পরীক্ষার্থীদের পাঠদান ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল, তাই পরীক্ষাটি নেওয়ার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। তারপরও না হলে বিকল্প চিন্তা করা যেত। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা কেউ বলতে পারে না। এ অবস্থায় পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত এল।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না নেওয়া প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরীক্ষা শুরু করার পর পরীক্ষার্থীরা আক্রান্ত হলে কী হবে? পরীক্ষা নেওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩০-৩২ কর্মদিবসের প্রয়োজন হয়। ২ হাজার ৫৭৯টি পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। এমনিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে এক বেঞ্চে দুজন শিক্ষার্থীকে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়। এখন কেন্দ্র দ্বিগুণ করতে গেলে দ্বিগুণ জনবল লাগবে। এ অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশ কী করেছে, সেগুলোও দেখা হয়েছে। বিভিন্ন দেশ পরীক্ষা বাতিল করেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অবশ্যই পরীক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের জীবনের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সরাসরি না নিয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা কী বলেন
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস লামিয়া বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। কিন্তু করোনার কারণে দীর্ঘ ছয়-সাত মাসেও পরীক্ষা হয়নি। এখন পরীক্ষা হলেও আগের মতো পরীক্ষা দেওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির কী হবে, সেটি নিয়ে কিছুটা চিন্তায় আছেন তিনি।
তবে সিলেটের সরকারি মহিলা কলেজের এক পরীক্ষার্থীর চিন্তা অন্য প্রসঙ্গে। তিনি মনে করেন, এভাবে ‘অটো’ পাসের কারণে ভবিষ্যতে বিদেশে ভর্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের সমস্যা হতে পারে। এ জন্য তাঁর চাওয়া অন্তত সিলেবাস কমিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে কোনো রকমে হলেও একটি পরীক্ষা নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কোনো কথা শুনতে না হয়।
এর আগে করোনা পরিস্থিতির কারণে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণির জেএসসি ও জেডিসির পরীক্ষা বাতিল করেছে সরকার। সর্বশেষ এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল হলো।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কবে হবে, তা নিয়ে ব্যাপক উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা ছিল সবার মধ্যে। সরকার এ পরীক্ষা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিল, তাতে এ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবসান হলো। আর কোনো বিকল্প এ মুহূর্তে ভাবা যেত কি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়।